"মানুষ মূলত একটা শব্দের অধিক আশ্চর্য কিছু নয়, একটা মাত্র শব্দই পারে তার সমুদয় কর্মকথা প্রকাশ করিতে।" --- কবি মুজিব মেহদী
এক রাজার খুব ইচ্ছা হল মানুষের ইতিহাস জানার। রাজ্যের সেরা জ্ঞানী, জ্ঞানী জৈল সিংকে ডাকা হল। রাজা তার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, যত লাগে সময় নাও, কিন্তু আমার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস চাই। অসম্ভব এ কাজের জন্যে জ্ঞানী রাজার কাছে সময় চাইলেন।
এরপর অনেকদিন পার হয়ে গেল। বিস্তর শ্রম দিয়ে পন্ডিত মানুষের ইতিহাস তৈরি করলেন। কোন এক শুভদিনে রাজার সামনে এসে উপস্হাপন করলেন, রাজা মশাই, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি, কিছু বাদ নাই। বরফযুগের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত মানব জাতির ইতিহাস সবই এ দশ খন্ডে পাবেন।
রাজা খুবই পুলকিত হলেন, যে এবার তিনি সব জানতে পারবেন। কিন্তু সমস্যা হল তার পড়ার সময় নাই। সব বাদ দিয়ে পড়াশোনা করলে, রাজকার্য করবেন কখন। মোসাহেবরাও সায় দিল। তিনি জ্ঞানীকে বললেন, যাও ছোট করে নিয়ে আস।
পন্ডিত এবার খেটেখুটে দশ খন্ড হতে পাঁচ খন্ডে নামিয়ে আনলেন। এবারও রাজা দেখলেন, আনন্দ ফুর্তি বাদ দিয়ে পাঁচ খন্ড পড়তেও অনেক সময় লাগবে। তিনি বললেন, আরও ছোট করে নিয়ে আস। এরপর পন্ডিত সংক্ষেপে তিন খন্ডে পুরো ইতিহাস রচনা করলেন।
রাজার দেখলেন রাজকার্যে মশগুল হলে তিনখন্ডও পড়ার সময় নেই, এদিকে জানতেও ইচ্ছে হয়। জ্ঞানীকে বললেন,আরও ছোট কর।
জ্ঞানী এবার পুরো দশ ভলিউমকে একখন্ডে এক মলাটে নিয়ে আনলেন। এদিকে রাজা মোসাহেব বেষ্টিত হয়ে আনন্দ-ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। পড়ার মত নীরস বিষয়ে সময় নষ্ট করার সময় তার নেই।
পন্ডিত মন খারাপ করে চলে গেলেন। বুঝতে পারল, রাজা কখনই পড়তে চায় না, অথচ রাজকীয় আভিজাত্য, গরিমায় জ্ঞানের রাজ্যেও তার অধিকার চায়।
পন্ডিত একদিন তাই রাজ দরবারে গিয়ে বলল, রাজামশাই , আপনার নির্দেশে আমি এক লাইনে মানুষের ইতিহাস রচনা করেছি। উজির, নাজির, সভাসদ সবাই উদগ্রীব হয়ে শোনার অপেক্ষা করতে লাগল।
পন্ডিত বলল, সংক্ষেপে, "এই পৃথিবীতে মানুষ জন্মগ্রহণ করে, খায়-দায়, আনন্দ-ফুর্তি, হাসি-কান্নার ভিতর দিয়ে বড় হয়, তারপরে সন্তানের জন্ম দেয়এবং একদিন মারা যায়"। এ হল মোটের উপর মানুষের ইতিহাস।
রাজা অত্যন্ত খুশী হলেন। তক্ষুণি তাকে 'জ্ঞানীরাজ' উপাধি দিলেন।
বইমেলায় গিয়ে আমার একবন্ধু, শুধু বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে। এরপরে ঐ বই নিয়ে আড্ডায় চাপাবাজি করে। পরে একসময় ধরা পড়ল সে কখনও পুরো বই পড়ে না, এটা তার স্বভাবে নাই। বড়জোর কোন বইয়ের রিভিউ পড়ে, তারপর ঐ নিয়ে চেঁচামেচি করে।
আরেকজনকে জানতাম , এককালে বিতর্ক করতেন,এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক। উনিও বই পড়তেন না, ফ্ল্যাপ পড়তেন, কোটেশান মুখস্হ করতেন। কোরাণের একই আয়াত, আরবী, বাংলা, ইংরেজিতে মুখস্হ রাখতেন বিতর্কের প্রয়োজনে। রবীন্দ্রনাথের 'নলকুপ' নিয়ে লেখা কবিতা ঠোঁটস্হ, আমি হয়ত জানি না যে রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। রসকস হীন বিষয় নিয়ে কবিগুরুর কবিতা কোট করে প্রতিপক্ষকে চমকে দেয়ার জন্যে তিনি ওটা মুখস্হ করেছেন।
এসব লোকের সাথে কথা বললে খুব জ্ঞানী মনে হয়। ও মা ! এত কিছু জানে!! নিজের উপর রাগ লাগে, আমি কেন জানি না। অবশ্য বিতর্কে আমার কোন আগ্রহ কোন কালে ছিল না।
বইমেলায় বইয়ের বিক্রয় বাড়ছে, লেখক, প্রকাশক সবাই খুশি। ফ্ল্যাপ/রিভিউ পড়া জ্ঞানীর সংখ্যাও বাড়ছে আশা করি। কিন্তু আসলে কতজন বই পড়ছে?
No comments:
Post a Comment