Welcome to the Opel's Galaxy

"Love is like a piano...at first you have to play it by its rules....then you must forget the rules and play it with your heart...."

Monday, October 20, 2008

বাংলাদেশে এক্টিভিস্ট হওয়া কি আদৌ সম্ভব (চার পর্ব একসঙ্গে)

পর্ব ১
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞানুসারে এক্টিভিজম হলো সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার জন্য স্বপ্রণোদিত কার্যক্রম। (http://en.wikipedia.org/wiki/Activism) তবে এক্টিভিজমের বিষয়টি এত ব্যাপক যে এই সংজ্ঞা তাকে বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট নয়। আমার উপলব্ধি অনুসারে এক্টিভিস্টরা একইসঙ্গে জ্ঞানী ও কর্মী, এমনকি সংগঠকও।
বিষয় বা ক্ষেত্র এবং মাধ্যম, এই দুই পরিপ্রেক্ষিতে এক্টিভিজমকে বোঝা যেতে পারে। কী কী রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তন এক্টিভিস্টরা আনতে চান, তা জানা গেলেই, এক্টিভিজমের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব। এক্টিভিজম মানেই প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ। এখন এই প্রতিরোধের ক্ষেত্রগুলো হতে পারে সাম্রাজ্যবাদ, জি-এইটের স্বার্থানুকূল পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন, এগ্রেসিভ কর্পোরেট কালচার, বিজ্ঞাপননির্ভর ভোগবাদিতা, মৌলবাদী জঙ্গিপনা, ঢালাও বেসরকারীকরণ, উন্নয়নের নামে পরিবেশধ্বংস, পুরুষতান্ত্রিকতা এবং সর্বোপরি যেকোনো ধরনের পীড়ন ও শোষণ। আর এই এক্টিভিজমের মাধ্যম হতে পারে বিচিত্র -- গৃহকোণে বসে লেখালেখি-ব্লগিং থেকে শুরু করে রাজপথে প্রতিবাদ পর্যন্ত। এক হিসেবে এক্টিভিজম বামপন্থী ঘরানার কাজ হলেও, অ-বামপন্থী লিবারেল বা সচেতন গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন নিযুত মানুষ বিশ্বব্যাপী নানা মাত্রার এক্টিভিজমের সঙ্গে যুক্ত। এককথায় বলা যায় এক্টিভিজমের লক্ষ্য হলো মানবমুক্তি।
বাংলাদেশ একটি এক্টিভিজমপ্রবণ দেশ, বাঙালিও সাধারণভাবে একটিভলি এক্টিভিস্ট। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জন্মের আগ পর্যন্ত বাঙালিরা মূলত রাজনৈতিক এক্টিভিজমের সঙ্গে যুক্ত ছিল, স্বাধীন দেশে এক্টিভিজমের বিচিত্র ক্ষেত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বাস করে কি আদৌ এক্টিভিস্ট হওয়া সম্ভব -- আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে সৎ ও খাঁটি এক্টিভিস্ট হওয়া? আমার উপলব্ধি, সম্ভবত, না।
আমার ব্যক্তিগত নিরবতার কথাটিই বলা যায়। আমি ১৯৯৯-২০০২ এই সময়কালে তিন বছরের বেশি সময়কালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত ছিলাম। ঐ বিভাগের সেলিম রেজা নিউটন, (ব্লগার) আ-আল মামুন, কাবেরী গায়েন এবং অন্য বিভাগের কয়েকজন সমমনা সহকর্মীর সান্নিধ্যে আমিও একরকম এক্টিভিজমে যুক্ত হই, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্বের নানা বিষয় নিয়ে পাঠ, আলোচনা, লেখালেখি, প্রকাশনা থেকে শুরু করে রাজপথে প্রতিরোধ সবই করি। সেই কয়েকটা উজ্জ্বল বছর ছিল আমার দীক্ষাগ্রহণের সময়, বন্ধুদের কাছ থেকে কিংবা নিজে নিজে।
২০০২ সালের মার্চে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসি।
সবাই তো সব বিষয়ে এক্টিভিস্ট হয়না। আমার পেশাগত ও আগ্রহের জায়গা থেকে যেকয়েকটি বিষয়ে আমার এক্টিভিজম পরিব্যাপ্ত রাখতে চাইতাম তা হলো:
১. আমি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলাম
২. আমি সাম্রাজ্যবাদের নমনীয় রূপ এনজিওদের কার্যক্রমের বিরোধী ছিলাম
৩. আমি বিশ্বায়নবিরোধী ছিলাম (সেহিসেবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফবিরোধী)
৪. আমি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরোধী ছিলাম (সেহিসেবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার বিরোধী ছিলাম)
৫. আমি মৌলবাদী জঙ্গিপনার বিরোধী ছিলাম।
৬. আমি মিডিয়ার তৎপরতাকে ক্রিটিকালি দেখতাম
৭. আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিরোধী ছিলাম
... ইত্যাদি
ঢাকায় চলে আসার পরে আমি দেখলাম বেতন পাই সাকুল্যে প্রায় ১০ হাজার টাকা, একটা সাধারণ ভদ্রস্থ বাসা ভাড়া করলাম, ভাড়া সাড়ে ছয় হাজার। ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়-পরিবারের সঙ্গে সাবলেটে থাকতাম। স্ত্রী সবে চাকরিতে ঢুকেছেন, বেতন অতি সামান্য। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই আমরা বাবা-মা হলাম, স্ত্রী চাকরি ছাড়লেন তার অতি-কাক্সিক্ষত সন্তানকে পৃথিবীতে ঠিকঠাকমতো আনার জন্য। সংসার বড়ো হতে থাকলো। আয় বাড়াতে হবে। নানা জনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম, পার্টটাইম কী করা যায়? উত্তর এলো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি, এনজিও, কনসাল্টেন্সি। কেউ কেউ বিশ্বব্যাংকের অনুবাদের কাজও দিতে চাইলেন। সবগুলোই আমার দিক থেকে চিহ্নিত সংস্থা, আমার এক্টিভিজমের লক্ষ্য।
সিদ্ধান্তহীন আমি উদভ্রান্তের মতো ঘুরি। পকেটে পয়সা নেই, ঘরে সন্তানের জন্য ব্যয়বহুল শিশুখাদ্য নেই, বাসাভাড়া বাকি, উপরি হিসেবে আছে আমার নীতিবাগিশতার প্রতি স্ত্রীর কটাক্ষ।

পর্ব ২
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে কী সুবিধে পাওয়া যেতো? একটা নিম্নভাড়ার বাসা, যা হাউসটিউটরশিপের বরাতে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি ছাড়া সেটা পাওয়া সম্ভব নয়। এই রাজনীতি না করা বা তার বিরোধিতা করাও আমার এক্টিভিজমের লক্ষ্য। যদি একটু দ্রুত প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হওয়া যেত, বেতন বাড়তো। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমার অস্থায়ী প্রভাষকের পদটা স্থায়ী হতেই পাক্কা তিন বছর লেগে গেল (এটা একটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি, তিন বছর সেবা দিলে অস্থায়ী পদ এমনিতেই স্থায়ী হয়ে যায়। বিভাগ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সত্যি হলো, একটা উদ্যোগকে ঝুলিয়ে/ফেলে রাখা হয়েছে)।
অগত্যা কী আর করা! সম্ভাব্য উপায়গুলো থেকে বিশ্বব্যাংকের অনুবাদকর্ম ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বাদ দিলাম। প্রভূত মানসিক পীড়নের মধ্য দিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিওকে বরণ করলাম। টুকটাক কাজ করলাম, তাও নিয়মিত কিছু না। বড়ো ডিগ্রি বা পদ না-থাকায় এসবের পেমেন্টও কম হয়ে থাকে। আর মতিউর রহমানের আহ্বানে প্রথম আলোয় কনসাল্টেন্সিগোছের একটা কাজ করলাম কিছুদিন; অথচ আমার মিডিয়া-এক্টিভিজমের লক্ষ্যই ছিল প্রথম আলো-ডেইলি স্টার। এভাবেই বেঁচে রইলাম, স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখলাম। কিন্তু মর্যাদাকর বেঁচে থাকা তা নয়। কেবলই গ্রাসাচ্ছাদন তা -- গৃহে বৈভব নেই, আত্মীয় পরিমণ্ডলে সম্মান নেই (পদের সম্মান আছে বটে, কিন্তু দীর্ঘদিন তাদের জন্য কিছুই করতে না-পারাটা তাকে ম্লান করে দেয়), বন্ধুমহলে আছে সহানুভূতিশীল করুণা।
কিন্তু এই আপস আমার এক্টিভিজমের লক্ষ্যের তালিকা ছোট করে দিল। এনজিওর সুবিধাভোগী হয়ে তো আর এনজিওর বিরুদ্ধে কথা বলা যায়না। আর সবচেয়ে ক্ষতি হলো প্রতিবাদের যে তেজ ছিল আমার, তা অনেকটা মিইয়ে এলো। যে একবার আপস করা শুরু করে, তার সামগ্রিক তেজের তীব্রতাই কমে আসে। তবে এর মধ্য দিয়েই চেষ্টা চললো তালিকায় আর যারা আছে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার। কিন্তু আগের সেই উদ্যম আর খুঁজে পাইনা।
পাশাপাশি কয়েক জায়গায় আপসের কারণে সৃষ্ট মানসিক পীড়ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অবশ্য বাংলাদেশে অনেককেই দেখা যায় জলে ও ডাঙায় সমান সক্রিয়, তারা এক্টিভিস্ট হিসেবে সৎ নয় বলে মনে করি। অনেক নামজাদা ও শ্রদ্ধেয় সাংবাদিককে দেখি মিডিয়ার হঠকারিতার সমর্থন গাইতে, সবচেয়ে বড়ো বিজ্ঞাপননির্মাতা হলেন সবচেয়ে বিপ্লবী চলচ্চিত্রকার বা থিয়েটারকর্মী। জানিনা মানসিক পীড়ন বা অন্তর্দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে আদৌ কাজ করে কিনা।
আমাকে এই আপস করতে হলো কেবল খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু খোদ পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে এক্টিভিস্টদের কেবল খাওয়া পরার জন্য এই আপস করতে হয়না। তাদের নানা ধরনের সোশ্যাল সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে, ভাতা আছে। একটা ধনবাদী দেশে একজন বেকারভাতা পেয়ে দিব্যি এক্টিভিজম চালিয়ে যেতে পারে। সিয়াটাল হোক আর হংকং হোক, প্লেনে উড়ে গিয়ে পশ্চিমা এক্টিভিস্টরা ডব্লিউটিওবিরোধী এক্টিভিজম করেন। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশে রাষ্ট্র কিছুই দেয়না। নাগরিকদের নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়। বেতন এত কম যে টিকে থাকতে হয় বাড়তি কাজ করে, নয়তো ঘুষ খেয়ে। আর সম্মানজনক বাড়তি কাজ সবসময় জোটেও না।

পর্ব ৩
আমার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গটি এখানে পাড়লাম কেবলই আলোাচনার সুবিধার্থে, ব্যক্তিজীবন বা সাংসারিক করুণদশা, কোনোটাই জানাতে নয়। আলোচনার খাতিরেই আমি এবার বাংলাদেশের কয়েকজন এক্টিভিস্টের নাম নিতে চাইবো। এরা হলেন ফরহাদ মজহার, শহীদুল আলম, রেহনুমা আহমেদ, আনু মুহাম্মদ, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ। এধরনের মাত্র কয়েকজনের নামোচ্চারণের মাধ্যমে অন্যদের খাটো করতে চাইনা, তবে এরা দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের এক্টিভিজমের সঙ্গে যুক্ত, এবং এদের কমবেশি সবাই চেনেন, এবং এদের নামের মাধ্যমে আমি আসলে আমার যুক্তি তুলে ধরতে চাই।
কবি ও লেখক ফরহাদ মজহার তার স্ত্রী ফরিদা আখতারের সঙ্গে নয়াকৃষিসহ নানা ধরনের এ্যাক্টিভিজমে যুক্ত। তার শিষ্যের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু তার মতাদর্শিক শিফট অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষত সাম্প্রতিক বাংলাদেশে প্যান ইসলামিক উন্মাদনার তাত্ত্বিক ভিত্তি তার লেখালেখি থেকেই দাঁড়িয়েছে। শহীদুল আলম বিখ্যাত ফটোগ্রাফার, ফটোগ্রাফি ও ব্লগের মাধ্যমে (http://www.shahidul.wordpress.com) তার এক্টিভিজম সর্বজনবিদিত। তবে পাঠশালা এবং দৃকের বিভিন্ন কার্যক্রমে ইউরোপনির্ভরতার কারণে তিনি কতটা স্বাধীনভাবে এক্টিভিজম চালিয়ে যেতে পারছেন তা নিয়ে আমি সন্দিহান। নৃবিজ্ঞানী-শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ তার শিক্ষকতা ও এক্টিভিজমের মাধ্যমে অনেক তরুণ এক্টিভিস্ট তৈরি করেছেন। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় তিনি মানবমুক্তির জন্য লিখে চলেছেন। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে লিখছেন, কিন্তু তার কথা নীতিনির্ধারকরা শোনেননা। বাংলাদেশের সেলিব্রেটেড অর্থনীতিবিদ হলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বা দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আনু মুহাম্মদ সক্রিয় রাজনীতিবিদ -- ফুলবাড়িসহ অন্যান্য জনগণের আন্দোলনে তার ভূমিকা অবিসংবাদিত। সলিমুল্লাহ খান মূলত তাত্ত্বিক, তবে মাঠেও তাকে পাওয়া যায়। আফগানিস্তান-ইরাক আক্রমণের সময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় এবং 'আহমদ ছফা রাষ্ট্রসভা'র সেমিনারসমূহে ফরহাদ-সলিমুল্লাহর যৌথতা বেশ নজরকাড়া ছিল, তবে সেই যৌথতা সম্ভবত আর বলবৎ নেই। এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি কেন্দ্রকে (কাক) ঘিরে সলিমুল্লাহ খানের এক্টিভিজম বর্তমানে চালু আছে।
এই এক্টিভিস্টদের মধ্যে আনু মুহাম্মদ ও রেহনুমা আহমেদ আমার বিশেষ প্রিয়। বাকিদের জ্ঞান ও কর্মে আমার শ্রদ্ধা থাকলেও নানা কারণেই একান্ত প্রিয় নন। তার কারণ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ কম। শুধু বলা যায় এই দুইজন এক্টিভিস্ট নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এবং এদের কারণেই মনে হতে পারে বাংলাদেশে খাঁটি এক্টিভিস্ট তাহলে পাওয়া সম্ভব।
তবে শুধু এই তথ্য দিয়েই এই সম্ভাবনাকে নাকচ করতে চাচ্ছি যে, দুজনেরই পিতৃপ্রদত্ত বা অন্যান্য উৎসের নানা সমর্থন আছে, থাকাখাওয়া বা জাগতিক অর্জন তাদের মৌলিক সমস্যা নয়। রেহনুমা আহমেদের পক্ষে জাবির অধ্যাপনার চাকরি একদিন হঠাৎ ছেড়ে দেয়া তাই সম্ভব হয়ে ওঠে। দাঁড়ানোর জমিন শক্ত থাকায় খাঁটি এক্টিভিস্ট হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
যা আমার বা আপনার পক্ষে হওয়া সম্ভব নয়।

শেষ পর্ব

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বিদ্যমান বাংলাদেশ-পরিস্থিতিতে এক্টিভিজমের কী দশা হবে তাহলে? মানবমুক্তির জন্য লড়াইয়ের পথ কি রুদ্ধই থাকবে? আপসের চোরাস্রোতে কি বরাবরই এক্টিভিস্টরা হারিয়ে যাবেন?

হারিয়ে যাওয়া অবশ্যই কাজের কথা নয়। এটা আমার জন্যও প্রযোজ্য, সত্যি বলতে আমি একেবারে হারিয়ে যাইওনি। এখন যেহেতু বিদেশে আছি, তাই ব্লগই আমার এক্টিভিজমের মাধ্যম। দেশে ফিরে গেলে পুরনো উপায়গুলোতে আবার যুক্ত হয়ে যাবো। আমার মনে হয় সৎ এক্টিভিস্ট হবার বা থাকার ইচ্ছেটাই একমাত্র রক্ষাকবচ এক্ষেত্রে। আপসের কারণে এক্টিভিজমের তালিকা ছোট হতে থাকুক, কিন্তু ইচ্ছেটা থাকুক, সক্রিয়তা বলবৎ থাকুক। ডিলেমায় দুলতে হবে, তবুও এক্টিভিজম চালু থাকুক। যিনি পেশাগত কারণেই এনজিওতে আছেন, তার তালিকা থেকে এনজিওবিরোধিতা অবশ্যই বাদ যাবে, কিন্তু অন্য ক্ষেত্রগুলোতে তিনি অবদান রাখতে পারেন। বিজ্ঞাপননির্মাতা বা সেলফোন কোম্পানির এক্সিকিউটিভের পক্ষে কর্পোরেট কালচারের বা জি-এইটের বিশ্বায়নের বিরোধিতা করা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় সমস্যা নেই। তবে এগুলো একেকটি একেকটির সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে থাকে যে, একটি আরেকটির এমন পরিপূরক যে, একটাকে আক্রমণ করতে গেলে আরেকটি প্রতি-আক্রমণ করতে উদ্যত হয়।একটা উদাহরণ দিই।
২০০৪ সালে আমি আর আ-আল মামুন যৌথভাবে একটি বইয়ের সম্পাদনা করি, শিরোনাম 'কর্পোরেট মিডিয়ার যুদ্ধ ও তথ্য বাণিজ্য: ইরাক, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন'। আমার বিভাগের সাবেক এক ছাত্র, যিনি লন্ডন থেকে উচ্চতর সব ডিগ্রি অর্জন করেছেন, শিক্ষক হবার যোগ্যতা থাকার পরেও যিনি ঢাকা, রাজশাহী বা চট্টগ্রামের কোনো বিভাগেই যোগদান করতে পারেননি, তবে ইউনিসেফের কমিউনিকেশন সেকশনে তিনি কর্মরত ছিলেন। আমি দূর থেকে তাকে শ্রদ্ধা করতাম। তাকে বইটা উপহার দিই, তিনি বইটা নিয়ে খুব উৎসাহ দেখালেন। একটা কাজের কাজ হয়েছে বলে মতপ্রকাশ করলেন। আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাই বইটার প্রকাশনা-উৎসবে আলোচক হবার জন্য। তিনি সানন্দে রাজি হন, যেন সম্মানিত বোধ করছেন, এরকম ছিল তার অভিব্যক্তি। কিন্তু প্রকাশনা-উৎসবের সময় ঘনিয়ে আসতে আসতে তিনি একদিন ইমেইলে জানালেন যে তার পক্ষে ঐ আলোচনায় আলোচক হওয়া সম্ভব নয়। তার বস নিষেধ করেছেন। বস মানে কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান, কোনো একজন পশ্চিমা সাদা চামড়ার মানুষ।
বিষয়টা তলিয়ে দেখলে কী পাই? ইরাক-আফগানিস্তান আক্রমণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যৌথভাবে। এই অন্যায় আগ্রাসনে সমর্থন দিয়েছে পশ্চিমা মিডিয়া। সেই মিডিয়ার তৎপরতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে যে বই, সেই বইকে নিয়ে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে আগ্রহী জাতিসংঘের একটি অঙ্গসংগঠনের একজন বাঙালি অফিসারকে আসতে দিলেন না যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশের একজন বস। এটি বসের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হতে পারে, আবার সাংগঠনিক নীতিমালার অধীনে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তও হতে পারে। যে উপায়েই সিদ্ধান্তটা আসুক, এইটা একটা সিদ্ধান্ত এবং এর অনেক মানে আছে।
এধরনের বাধা এক্টিভিজমের জন্য সবসময়ই আসবে, কিন্তু এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়। এই তথ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক নয় যে আমার সেই শ্রদ্ধেয় জন বর্তমানে ইউনিসেফ ছেড়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঢাকা অফিসের কমিউনিকেশন বিভাগে কাজ করছেন। আমাদের সবার এক্টিভজমই যদি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চাকুরে হবার মধ্য দিয়ে শেষ হয়, তবে তার ফলাফল হবে মারাত্মক। আশা করি এই নিয়তি সবার জন্য প্রযোজ্য হবেনা।
তবে বিপজ্জনক হলো গাছের ওপরে এবং তলায় একইসঙ্গে বিরাজ করা। এই প্রবণতা বিভ্রান্তিকর, প্রকৃত এক্টিভিজমের জন্য বাধাস্বরূপ। নারীবাদী নেত্রী হয়ে 'ফেয়ার এন্ড লাভলী ফাউন্ডেশন'-এর উপদেষ্টা প্যানেলে অবদান রাখা হলো পরিস্কার হিপোক্রিসি -- মিডিয়ায় যেমন মঙ্গলবারে 'নকশা', বুধবারে 'নারীমঞ্চ' থাকে; একটায় রূপচর্চার টিপস, আরেকটায় নারী-অধিকারের টিপস।

সবকিছুর মতো এক্টিভিজমের ক্ষেত্রেও সততা একটি পূর্বশর্ত।

মূল লেখাঃ

No comments: